মাতৃত্ব নারীর জন্মগতভাবে পাওয়া এক আশীর্বাদ। একজন নারী যখন বুঝতে পারে সে মা হতে চলেছে এর চেয়ে আনন্দের কোনো মুহূর্ত তার জীবনে আর হয়না। সাধারণত গর্ভে সন্তান আসার পর সেটি বুঝতে কয়েক সপ্তাহ লেগে যায়। এরপর বিভিন্ন পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে গর্ভের শিশু আস্তে আস্তে বড় হতে থাকে। এই পুরো সময় একজন নারী কে অনেক শারীরিক এবং মানসিক পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যেতে হয়।

গর্ভাবস্থায় মা এর শরীর মন এর পরিবর্তন গুলো যেভাবভাবস্থাঃ

গর্ভাবস্থার প্রথম তিন মাস  একজন মায়ের জন্য খুবই  গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এই সময়টায় শরীর কে হুট করে নানা পরিবর্তনের সাথে মানিয়ে নিতে হয়। যেমন ক্লান্তি , অবসাদগ্রস্ততা ,বমি বমি ভাব, ,মাথা ঘোরা ইত্যাদি। আর এই শারীরিক পরিবর্তনগুলো আস্তে আস্তে মনের উপর ও প্রভাব ফেলতে শুরু করে।

মানসিক অস্থিরতা , খিটখিটে  মেজাজ , বিষন্নতা , শঙ্কাবোধ সহ নানান উপসর্গ। যাকে বলা মুড সুইং (mood  swing)। এই সব পরিবর্তনের মূল কারণ হলো গর্ভধারণের ফলে শরীর এ নির্দিষ্ট পরিবর্তিত হরমোন এর প্রভাব। তবে এ প্রভাব কারো কারো কম আবার কারো ক্ষেত্রে বেশিও হতে পারে। কারো ক্ষেত্রে বমির ভাব টা বেশি থাকে ফলে একেবারেই খাওয়ার ইচ্ছা থাকেনা। নির্দিষ্ট খাবার এর কিংবা অন্য যে কোনো রকম গন্ধ বিরক্তির উদ্রেক করে এবং খাবার খেতে অনীহা প্রকাশ পায়। আবার কারো ক্ষেত্রে এই বেপারটা একেবারে নাও হতে পারে। কারো হয়তো মাথা ব্যথা কিংবা মাথা ঘোরানোর উপদ্রপ বেশি হতে পারে। এটা ঘটে থাকে হরমোনের ব্যালেন্স উপর ভিত্তি করে। কেউ কেউ হয়তো মানসিক ভাবে একেবারেই চিন্তিত নন বা মানসিক পরিবর্তনের দিক গুলো এলেও সামলে নিয়েছেন নিজেকে আবার কাউকে দেখলে মনে হবে তিনি খুব দুশ্চিন্তাগ্রস্ত তার শারীরিক ও অন্যান্য পরিবর্তনগুলো নিয়ে এবং তার আচরণ এ কিছু লক্ষণীয় পরিবর্তন দেখা যায়।

বিভিন্ন ট্রাইমেস্টার কি কি পরিবর্তন হয় :

গর্ভকালীন নয় মাস কে তিনটি ভাগ এ ভাগ করে পর্যায়ক্রমিক প্রতি তিন মাসকে বলা হয় ট্রাইমেস্টার (Trimester) । প্রতি ট্রাইমেস্টার এ ভ্রূণের বৃদ্ধিতে মা এর শরীর এর পরিবর্তন গুলো আলাদা আলাদা রকমের  হয়ে থাকে। আবার প্রতিটি ট্রাইমেস্টার এর ভেতর এ একেক সপ্তাহের পরিবর্তনগুলোও আলাদা।

প্রথম ট্রাইমেস্টার:

গর্ভধারণের শুরুতেই মা শারীরিকভাবে অনুভব করতে পারেন না যে তিনি গর্ভবতী। অনুভূত হবার আরো চার সপ্তাহ আগে তিনি গর্ভধারণ করে থাকবেন। যদিও প্রথম বা দ্বিতীয় সপ্তাহে হোম প্রেগন্যান্সি টেস্ট বা অন্য কোনো টেস্ট এর মাধ্যমে জানা সম্ভব যে গর্ভধারণ হলো কিনা। তবে শারীরিক উপসর্গ গুলো দেখা দিতে শুরু করে পঞ্চম সপ্তাহ থেকে। এ সময় শরীর এ মাথা ঘোরানো সহ বমির ভাব , খাওয়ার অনিচ্ছা , ক্লন্তিবোধ , অবসাদগ্রস্ততা ইত্যাদি হতে দেখা যায়। ভ্রূণের বৃদ্ধি খুব দ্রুত হতে থাকে। হৃদপিন্ড , পাকস্থলী , লিঙ্গ  ও কিডনির গঠন শুরু হতে থাকে। ষষ্ঠ ও সপ্তম সপ্তাহে মা এর মানসিক পরিবর্তন গুলো দেখা দিতে থাকে। আচরণগত কিছু পরিবর্তন পরিলক্ষিত হয়। এ সময় বাচ্চার চোখ ,নাক ,কান ,চিবুক গঠন ও রক্ত চলাচল  ব্যবস্থা শুরু হয়। এ সময় সুষম খাবার গ্রহণ ও পর্যাপ্ত বিশ্রাম এর প্রয়োজন। তবে এ সময় বাচ্চার ওজন খুব একটা বাড়েনা কিংবা মা কে দেখে গর্ভবতী বলে মনে হয় না।

এর পর অষ্টম ও নবম সপ্তাহে বাচ্চার দাঁত এর গঠন শুরু হয়। বাচ্চা প্রায় ১২ -২০ মি.মি. পর্যন্ত লম্বা হয়। এ সময় মা অল্পতেই ক্লান্তি বোধ করে থাকেন এবং বড় হজম এর সমস্যা দেখা দিতে পারে। তাই একেবারে বেশি খাবার না খেয়ে বার বার অল্প অল্প করে খেতে হবে। মা এর মানসিক অস্থিরতা বা মুড সুইং এ সময় একটি উল্লেখযোগ্য স্বাভাবিক বিষয়। ১০- ১২ তম সপ্তাহে বাচ্চা প্রায় ৫-৬ সে.মি. পর্যন্ত লম্বা হয়। মা এর ওজন বৃদ্ধি পরিলক্ষিত হয়। বাচ্চার মুখের গঠন বুঝা যায় শরীর এর চেয়ে মাথা বেশি বড় হয়।

দ্বিতীয় ট্রাইমেস্টার :

১৩-১৪ তম সপ্তাহে মা এর মাথা ঘোরানো বা বমির ভাব কমে আসবে আর আগের চেয়ে সুস্থ বোধ করে থাকবেন। এ সময় বাচ্চা ৯- ১০ সে. মি.   লম্বা হয়ে থাকে। বাচ্চার স্বশনতন্ত্র ও খাদ্যতন্ত্র গঠিত হয় ! মা বাচ্চার নড়াচড়া অনুভব করবেন।  ১৫- ১৬ সপ্তাহে বাচ্চা প্রায় ১২ সে. মি. পর্যন্ত লম্বা হয়। বাচ্চার হাত , পা এর নখ ও চুল তৈরী হয় এবং কান চোখ সঠিক অবস্থানে আসে।  এ সময় মা এর হাত পা এ পানি চলে আসতে পারে। তাই হালকা ব্যায়াম করা ও হাটাহাটি কিংবা চলাফেরা করা উচিত। দাঁত এর মাড়ি ফোলা ও রক্ত পড়া ইত্যাদি দেখা দিতে পারে। তাই ডেন্টিস্ট এর পরামর্শ নিতে হবে।

১৭- ১৮ সপ্তাহে বাচ্চা ১৫ সে. মি. লম্বা হয় , নড়াচড়া করার সুযোগ পায় ও শব্দের অনুভূতি পেতে শুরু করে। চিকিৎসকদের মতে  মা এর শরীর থেকে সাদাস্রাব নির্গত হওয়াটা স্বাভাবিক তবে তা যদি সহনীয় পর্যায়ের না হয় তাহলে  চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। ১৯-২২ সপ্তাহে বাচ্চা সর্বোচ্চ ২০ সে. মি.  পর্যন্ত লম্বা হয়। এবং তার স্বাদ গ্রন্থি তৈরী হয়। মা এর  ওজন  অত্যন্ত  দ্রুত বৃদ্ধি পায় ।  এ সময় ডাক্তাররা মা এর ডায়াবেটিকস পরীক্ষা করানোর কথা বলে থাকেন। ২৩-২৬ তম সপ্তাহে বাচ্চার ফুসফুস এর পূর্ণাঙ্গতা আসতে থাকে এবং ২৫ মি মি পর্যন্ত লম্বা হয়ে থাকে। এ অবস্থায় বাচ্চা প্রথম চোখ খুলতে পারে।

তৃতীয় ট্রাইমেস্টার :

তৃতীয় ট্রাইমেস্টার শুরু হয় ২৭ তম সপ্তাহ থেকে। ২৭- ৩০ তম সপ্তাহে বাচ্চা ২৮ সে. মি. পর্যন্ত লম্বা হয়ে থাকে। যেহেতু প্রসবকালীন সময় আসন্ন তাই এ সময় অনেক মায়ের নির্দিষ্ট সময় এর আগেই কিছু প্রিটার্ম লেবার সিম্পটম দেখা দিতে পারে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য উপসর্গ গুলো হলো পেট ব্যথা, কোমর এ প্রচন্ড ব্যথা , পানি ভেঙে যাওয়া , জরায়ু থেকে রক্ত বা পিচ্ছিল পদার্থ বের হওয়া ইত্যাদি। তেমন হলে দ্রুত ডাক্তার এর শরণাপন্ন হতে হবে এবং ব্যবস্থা নিতে হবে। এ সময় স্তন থেকে শাল দুধের নিঃস্বরণ হতে পারে। ৩১-৩৪ সপ্তাহে বাচ্চা ৩৩ সে. মি.  পর্যন্ত লম্বা হয় ! আশে পাশের জিনিস দেখতে পায়  ও অনুভূতি বুঝতে শেখে। এ সময় থেকেই প্রসব ব্যথার লক্ষণগুলো জেনে রাখা ভালো।

৩৫-৩৮ সপ্তাহে বাচ্চা ৩৭ সে. মি.  লম্বা হয় আর সে একটি পূর্ণাঙ্গ গঠন লাভ করে। গর্ভের শিশুটি তখন মা এর শরীর থেকে প্রচুর পরিমান এ মিনারেল গ্রহণ করে এবং মা এর শরীর আয়রন এর চাহিদা তীব্র থাকে। মা এর প্রচুর সাদাস্রাব এবং ঘন ঘন প্রস্রাব  হতে পারে। ৩৯-৪০ তম সপ্তাহ গর্ভাবস্থার সর্বশেষ পর্যায়। এ সময় ওজন অত্যন্ত দ্রুত গতিতে বাড়ে ও যে কোনো সময় প্রসব এর লক্ষণ দেখা দিতে পারে। বাচ্চা ৩৭ সে.মি. পর্যন্ত লম্বা হয়। শেষ সপ্তাহ গুলোতে তাই বাড়তি  সতর্কতা ও প্রস্তুতি নেয়া জরুরি। এ সময় অতিক্রম করেই গর্ভের শিশুটি পৃথিবীতে ভুমিষ্ট হবে।

গর্ভাবস্থায় সাধারণত সমস্যা গুলো সেগুলো সমাধানে করণীয় :

গর্ভাবস্থায় মা এর শরীর এ যে কোনো সময় যে কোনো ধরণের জটিলতা দেখা দিতে পারে। তাই এসব সমস্যা সমাধানে প্রাথমিক ও পূর্বপ্রস্তুতি থাকা প্রয়োজন। গর্ভকালীন বিভিন্ন ট্রাইমেস্টার এ বিভিন্ন শারীরিক পরিবর্তন এর ফলে মা এর শরীর এ নানা সমস্যা দেখা দিতে পারে। ধীরে ধীরে মা এর শরীর ওজন বৃদ্ধিতে শরীর এ ব্যাপক প্রভাব ফেলে। দেখা যায় মা একসাথে বেশি খাবার খেতে পারছেন না অথচ তার বাড়তি খাবারের প্রয়োজন। সে ক্ষেত্রে তাকে অল্প অল্প পরিমানে বার বার খেতে হবে। এ সময় মিনারেলস আয়রন এর চাহিদা বেশি থাকে তাই মিনারেল আয়রন সমৃদ্ধ খাবার খেতে হবে। পর্যাপ্ত বিশ্রাম নিতে হবে। যথাসময় এ ডাক্তার এর পরার্মশ  মতো প্রয়োজনীয় টিকা নেয়া ও ঔষধ সেবন সেবন করতে হবে। গর্ভস্থ শিশুর বৃদ্ধিতে মায়ের শরীর এ বিশেষ করে চামড়ায় শুস্কতা দেখা দেয় তাই এর জন্যে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। গর্ভকালীন জটিলতা দেখা দিলে তা প্রতিকার এর ব্যাবস্থা রাখতে হবে। নিকটস্থ হাসপাতাল এ আগে থেকে প্রয়োজনীয় চিকিৎসার ব্যাবস্থা করে রাখতে হবে।

যেসব মারাত্মক লক্ষণ দেখে বোঝা যাবে গর্ভবর্তী ঝুঁকির সম্মুখীন সেগুলো হলো-

১. হাত-পা ফুলে যাওয়া  
২.অত্যধিক বমি হওয়া 
৩. প্রসবের আগে রক্তক্ষরণ বা পরে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ 
৪. তীব্র মাথাব্যথা 
৫. চোখে ঝাপসা দেখা 
৬. তীব্র জ্বর 
৭. ১২ ঘণ্টার বেশি সময় ধরে প্রসব ব্যথা 
৮. দুর্গন্ধযুক্ত কোনো স্রাব 
৯. খিঁচুনি  
১০.প্রসবপথে গর্ভস্থ শিশুর মাথার পরিবর্তে অন্য কোনো অংশ দেখা দেওয়া ইত্যাদি।

এ ধরনের যেকোনো একটি সমস্যা দেখা দিলে দ্রুত অভিজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শে চিকিৎসা নিতে হবে। তা না হলে গর্ভবতীর বিপদ হতে পারে। গর্ভবতী মায়ের গর্ভকালীন সুস্থতা নিশ্চিত করার মাধ্যমেই কেবল মাত্র সুস্থ সুন্দর শিশুকে পাওয়ার আনন্দ আশা করা উচিৎ।

গর্ভকালীন বিভিন্ন সময়